বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী পৌরসভা ছিল। ১৭৬৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী থেকে বিকন লাল পান্ডে (যিনি বেনু ঠাকুর বা লক্ষী নারায়ণ ঠাকুর পান্ডে নামে পরিচিত ছিলেন ) কয়েকটি মৌজা লিজ গ্রহণ করেন। এ জায়গায় পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ নগর গড়ে উঠে। বৃটিশ সরকার ১৮৭৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ২৭,৮৭৬ জন জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৪.৫ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা গঠন করে। ৪ জন মনোনীত এবং ৮ জন নির্বাচিত কমিশনার নিয়ে এ পৌরসভার অভিযাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা একটি “মডেল পৌরসভা” হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯৩১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা চিটাগাং ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোং এর সহায়তায় পৌর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করে। এর পূর্বে শহরের বাতিগুলো ছিল কেরোসিন নির্ভর। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা শত বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে ব্যবসা বাণিজ্যে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এবং রাজধানী “ঢাকার প্রবেশ দ্বার” হিসেবে পরিচিত । শীতলক্ষ্যা নদীর স্বচ্ছ পানি এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বৃটিশ আমলে নারায়ণগঞ্জ একটি ব্যস্ততম বন্দর বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। এক সময় নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর থেকে স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল এবং নারায়ণঞ্জ থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সকল ট্রেন ছেড়ে যেত। সড়ক, ট্রেন ও স্টিমার সার্ভিস সম্বলিত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নারায়ণগঞ্জ নগরকে পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত করে তোলে। এ জন্য নারায়ণগঞ্জ বিশ্বময় “প্রাচ্যের ডান্ডি” (Dundee of the East) হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী ঘনবসতিপূর্ণ শিল্প সমৃদ্ধ এ বন্দর নগরী এখনো বাণিজ্যিক বন্দর নগরী হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বর্পূণ অবদান রেখে যাচ্ছে।
বৃটিশ সরকার ১৮৭৬ সালে এইচ টি উইলসন-কে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম বাঙ্গালী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ মালেহ। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজই ছিল শহরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও উন্নত নাগরিক সেবা প্রদান। পাঁচ বছর পর ১৯৭৭ সালে তিনি পুনরায় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নারায়ণগঞ্জ শহরের উন্নয়নে তিনি যে আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছিলেন বিধায় প্রতিদানে নারায়ণগঞ্জবাসী তাঁকে দ্বিতীয়বার পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। পরবর্তীতে জনাব নাজিম উদ্দিন মাহমুদ চার বছর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর (১৯৮৮-২০০৩) নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিল না। উক্ত সময় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা প্রশাসক কর্তৃক পরিচালনা করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালে পুনরায় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রয়াত আলী আহাম্মদ চুনকার সুযোগ্য কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০০৩ সালের পৌর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে ২০১১ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
০৫ মে ২০১১ তারিখে এ তিনটি পৌরসভা যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুল কে একীভুত করে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠা বিধিমালা ২০১০ এর বিধি ৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার প্রায় ৭২.৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে ।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সিটি নির্বাচনে পুনরায় ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত ৩য় সিটি নির্বাচনে টানা ৪র্থ বারের মত মেয়র নির্বাচিত হন।